অতীতাস্যে

function show(elementID) { var ele = document.getElementById(elementID); if (!ele) { alert("no such element"); return; } var pages = document.getElementsByClassName('page'); for(var i = 0; i < pages.length; i++) { pages[i].style.display = 'none'; } ele.style.display = 'block'; }
নব্বই দশকের শুরুতে দূরদর্শনে প্রচারিত 'চানক্য' সিরিয়ালটি এখনো পর্যন্ত আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সিরিয়াল। রবিবার সকালে এই সিরিয়ালটির জন্যে সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতাম। আমি চাকরীসূত্রে ঐ সময়ে আমার প্রথম প্রবাস ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম। তখনও একলা মেসে থাকি, বাড়ী পাইনি। আমার কাছে তখন টিভিও ছিল না। প্রতি রবিবার সকাল ন'টায় আমাদের মেসের কমনরুমে বা কোন প্রতিবেশীর বাড়ীতে হানা দিতাম। কর্ণাটকের মানুষ সহিষ্ণু নিশ্চই, আমাকে বিমুখ করতো না। বাঙালি সহকর্মীরা বলতো, দাদার যত আঁতলামো, আর্ট ফিলিম দেখেন।
'আর্ট ফিলিম' নয়, আমার আকর্ষণ ছিল ইতিহাস। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম দু'হাজার বছরের পুরনো ভারতের একটা অবিশ্বাস্য 'বিশ্বাসযোগ্য' উপস্থাপনা!
অথচ মজার কথা হল, ইস্কুল-জীবনে আমার ইতিহাস-বিরাগ ছিল সবার জানা। ইতিহাস চেতনার বালাই ছিল না। স্কুলের পাঠ্যক্রমের নির্দিষ্ট বইখানাই ছিল অতীতের সঙ্গে আমার একমাত্র যোগাযোগ। কিন্তু সে বই দুই মলাটের মধ্যে একরাশ নীরস ও নিরর্থক অক্ষর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এই অপার্থিব বিকর্ষণের পেছনে অবশ্য আমাদের ইতিহাস শিক্ষক শিশিরবাবুর অবদান ছিল অনেকটা। ইতিহাসের ক্লাস নেবার নামে তিনি ছাত্রদের শরীরগুলো ব্যবহার করতেন বক্সিঙের পাঞ্চিং ব্যাগ হিসেবে। ক্লাসে এসেই তিনি আগের দিনের পড়া ধরতেন। আর পড়া ধরা মানে আগের ক্লাসে দেওয়া ইতিহাসের অধ্যায়টা অক্ষরে অক্ষরে মুখস্ত বলে যাওয়া। একটি শব্দ এদিক-ওদিক হলেই--।
একের পর এক সার দিয়ে দাঁড়ানো ব্যাগগুলি পাঞ্চ করে যেতেন শিশিরবাবু। ক্লাশ শেষ হয়ে আসতে আসতে মানে হয় তাঁর হাত ব্যথা হয়ে যেত। কিন্তু সামান্য হাতের ব্যথায় তিনি ছাত্রদের 'শিক্ষিত' করবার ব্রত থেকে বিচ্যুত হতেন না। এইভাবে অনেকগুলি ছাত্রের সঙ্গে মহড়া শেষ করে হাত-টাথ ঝেড়ে হৃষ্টচিত্তে তিনি ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন, তার আগে পরের দিনের চ্যপ্টারটা পড়া দিয়ে দিতেন। তাঁর দুচোখে তখন থাকত খুশীর ঝিলিক। আগামী ক্লাশের নতুন উদ্যমে মহড়া নেবার প্রস্তুতির জন্য। 
বেশ মনে আছে গদার মতো কালো রোমশ ঐ হাতের ভয়ে ইতিহাস শেখা চুলোয় গেছিল। কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথম পাতার উত্তর-পশ্চিম কোন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোন পর্যন্ত ঝাড়া মুখস্ত করে যেতাম। আর মনে মনে ইতিহাসের গুষ্টির পিন্ডি চটকাতাম।
স্কুলে যখন ইতিহাস পড়ার পাট সাঙ্গ হল, শিশিরবাবুর ভয়ও দূর হল। কিন্তু ইতিহাসে বিতৃষ্ণাটা রয়ে গেল। অবশেষে শিশিরবাবুর কালো হাতের স্মৃতি মুছে দিল ইতিহাসের গল্প! ক্রমে জানতে পারলাম, ইতিহাসের রস। ইতিহাস হল গিয়ে অতীতকে দেখবার চেষ্টা। আমরা পুরুষানুক্রমে প্রিয়জনদের হারিয়েছি। তারপর তাদের ভুলেও গিয়েছি। অথচ সেই সব মানুষ, যারা ইতিহাস গড়েছে তাঁরা আজও আমাদের মনে জীবিত। আমরা যতদিন আছি, তাঁরাও অমর। শুধু সময়ের একটা কালো পর্দা তাঁদের আড়াল করেছে। কিন্তু সেই পর্দা কিছুটা হলেও সরানো যায়। যারা চলে গেছে তাদের সব চিহ্ন মুছে যায় না। খুঁজে দেখতে হয়। সবাই পারে না। কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক আছেন, যাঁরা সেই জাদু জানেন। তাঁদের গবেষণা এক অজানা জগতের অন্বেষণ নির্মাণ করে। আর সেই অন্বেষণ মোটেই কেতাবী অনুশীলন থাকে না।
আর ঐতিহাসিকেরা যেখানে নীরব হয়েছেন, শক্তিমান কিছু সাহিত্যিকের অলৌকিক মনীষায় আমরা দেখেছি হারানো অতীতকে। প্রত্ননির্দেশ না পাওয়া গেলে তাঁরা কল্পনায় রচনা করেছেন সম্ভাব্য অতীত। বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবিকতায় তুলে এনেছেন বহুযুগে আগের সব কল্পমুহূর্ত।
বঙ্কিমচন্দ্রই শুরু করেছিলেন। তারপর সেই পথে হেঁটেছেন ও আরও অনেকে। বহু শতাব্দীর জমে থাকা বিস্মরণের ধুলো সরিয়ে এঁরা পুনর্নির্মাণ করেছেন সেই সব ছবি, কালের করাল পরশে যা বিনষ্ট হয়েছিল। তাঁদেরই কলমের কৃপায় আমার এই অতি বিতৃষ্ণার বিষয়টি হয়ে উঠলো একান্ত প্রিয়।
এইসব গুণী লেখকদের মধ্যে আমাকে অতীতমুখী করতে কোন একজনের নাম করতে হলে সে নাম অবশ্যই শ্রীশরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের। শরদিন্দুবাবু মূলত সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ চরিত্রের স্রষ্টা। তাঁর ভিন্নমুখী গোয়েন্দা গল্পগুলি আজও উৎকৃষ্ট সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু তাঁর পাঁচটা ঐতিহাসিক  উপন্যাস ও গোটা কুড়ি ইতিহাসসুরভিত গল্প যেন যাদুদণ্ড!
আজকের নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে অতীতগন্ধা রচনার জনপ্রিয়তা বোধহয় খুব বেশী নেই। প্রাচীনকালের গল্প তারা আর পড়ে না। অর্বাচীন আলস্য ও উন্নাসিক তাচ্ছিল্যে তারা নিজেদের প্রতারিত করছে। অসীম আস্যে আমি তাদের বলতেই পারি, যতই আধুনিক বৈদগ্ধের বড়াই করো, তোমরা করুণার পাত্র। হে নতুন যৌবনের দূত, তোমরা জানো না কি রসে বঞ্চিত তোমরা! তোমাদের জন্য আমি অনুকম্পা অনুভব করি।
শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক রচনাগুলি হল আমার নবদিগন্তের দিশারী। আমার মধ্যে ঐতিহাসিক গল্পের প্রতি একটা আগ্রাসী আকর্ষণ তৈরি হবার মূলেও তাই। তাঁর লেখা পড়ার পরেই আমার ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। খুঁজে খুঁজে পড়া শুরু হল রমেশ্চন্দ্র, রাখালদাস, গজেন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ, নারায়ণ সান্যাল মশাইএর রচনা। রেফারেন্স হিসেবে বিদেশী লেখকের বইগুলি ছাড়াও আছেন সচ্চিদানন্দ, রমিলা থাপার, যদুনাথ সরকার প্রভৃতি। সবশেষে বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি একটু বেশী ভারী, মহার্ঘ বেনারসীর মতো রয়ে সয়ে ব্যবহারের।
ক্রমেই দেখি ইতিহাস আর নীরস নেই। নতুন পত্র-পত্রিকা হাতে এলেই আগে খুঁজে দেখি ঐতিহাসিক গল্প।

শরদিন্দুবাবু ইতিহাস চেতনার বীজটি মাথায় বুনে দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে লব্ধ হল কিছু ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। তার মধ্যে ছিল খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রচিত দুখানা সংস্কৃত নাটক— মুদ্রারাক্ষস এবং দেবীচন্দ্রগুপ্তম। একটির কাহিনীকাল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বলাভের পরবর্তী সময় ও অন্যটি উত্তর-সমুদ্রগুপ্ত কালে। দু'টিরই রচয়িতা বিশাখদত্ত নামক সেকালের এক কাব্য-নাট্যকার। কিঞ্চিৎ ইতিহাস চেতনার উন্মেষ হওয়ায় এই দু'টি প্রাচীন আখ্যান আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল।
শুরুতে যে টিভি ধারাবাহিকের উল্লেখ করেছি, ঐ সিরিয়ালের অনেকটা অংশ 'মুদ্রারাক্ষস' থেকে নেওয়া। এটি নন্দরাজ ধননন্দের প্রধানমন্ত্রীর-- অতীব সুপুরুষ হওয়া সত্বেও নাম তাঁর রাক্ষস-- আংটি চুরির রহস্য। একটা গোয়েন্দা গল্প সংকলনের ভূমিকায় মুখবন্ধকার একে আদি গোয়েন্দাকাহিনী বলেও অভিহিত করেছিলেন। আমি আবার সংস্কৃতে মহাপন্ডিত(!), তাই মূলরূপে নাটকটি পড়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ইংরেজি অনুবাদ পড়ে আমি বুঝেছিলাম, সেকালের মানুষ ধৈর্যবান ছিল নিশ্চই। তাই এতো অতিরঞ্জন, এতো অপ্রাসঙ্গিকতা, এতো শিথিল রচনাশৈলী বরদাস্ত করেছে। আজকালকার পাঠক করবে বলে মনে হয় না। চাণক্য ধারাবাহিকটি দেখা না থাকলে মুদ্রারাক্ষসের মূলকাহিনী উদ্ধার করতে পারতাম না।
'দেবীচন্দ্রগুপ্তম' এর কাহিনী প্রথম পড়েছিলাম আরও আগে, 'অমর চিত্রকথা'য়। নাটকটির উপজীব্য সমুদ্রগুপ্তের পুত্র চন্দ্রগুপ্তের নাটকীয় ভাবে রাজ্যলাভের ঘটনা।
দুটি রচনাতেই যে গল্প বলা হয়েছে, কোনও প্রামাণ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিরিখে তার সত্যতা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঐতিহাসিকেরা বর্ণিত ঘটনা কাল্পনিক বলেই মনে করেন। এমনকি দেবীচন্দ্রগুপ্তম নাটকে চন্দ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজা রামগুপ্তের অস্তিত্বও ঐতিহাসিকেরা পুরোপুরি স্বীকার করেন না, যদিও ঐ নামের এক সমসাময়িক ব্যক্তির উল্লেখ ইতিহাসে আছে। তবে এই নাটকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (গুপ্তবংশীয়) ও ধ্রুবাদেবী এবং মুদ্রারাক্ষসে উল্লিখিত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্য ঐতিহাসিক চরিত্র।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সেকালে বাস্তব চরিত্র সম্বলিত গল্প-নাটকে নায়কের বীরত্ব বা নায়িকার সৌন্দর্যের অতিরঞ্জন থাকলেও, রচয়িতা কাল্পনিক ঘটনা বা চরিত্রের সমাবেশ সাধারণত করবেন না।
তা প্রামাণিকতা থাক বা না থাক, নাটক দু'টির ঘটনায় যে অভিনবত্ব আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দুটো কাহিনীতেই ছিল এযুগের উপযোগী বেশ এক-একটা 'নাটকীয়' গল্পের উপাদান। মনে হত, আহা শরদিন্দুবাবু যদি থাকতেন আর এই নিয়ে কিছু লিখতেন! কিন্তু তিনি চলে গেছেন, অন্যান্য মহারথীরা আর কেউ নেই। কে লিখবে সেই গল্প?
ঐতিহাসিক রচনা প্রসঙ্গে এই নাটকদুটোর কথা রঙ্গনদাকে শুনিয়েছিলাম। শুনে-টুনে রঙ্গনদা বলল, তা লিকে ফ্যাল। তোর তো আবার লেখালিখির ইয়ে আছে।
শোনো কথা! সেই রঙ্গনদা, যে কিনা একসময়ে আমার সাহিত্যচর্চায় জল ঢেলে দিয়েছিল। বলতে গেলে আমার লেখালিখি প্রায় বন্ধই করিয়ে ছেড়েছে! বলেছিল, বালখিল্য পাগলামি। সেই এখন উল্টো কথা বলে। রাগ দেখিয়ে বললাম, কী যে বল রঙ্গনদা। ওসব আমি কখনো পারি?
—আহা, মানুষ ইচ্ছে করলে কিনা পারে, রঙ্গনদা পুরনো কথা সব ভুলে মেরেছে। বলল, তুইও পারবি। তবে হ্যাঁ, দেখিস ভাষাটা নিয়ে ছ্যাবলামো করিসনি যেন। সাধুভাষার পাকামো বা চলিত ভাষার আদিখ্যেতা-- কোনটাই চলবে না। ভাষাটা রাখবি চলিতে, কিন্তু ঘটনাকালের প্রাচীনতা বোঝাতে একটু অলঙ্কৃত। যেমন সিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাক দেখাতে সিপিয়ার ব্যবহার।
আলোচনাটা তখনকার মতো আর বেশী বাড়তে দিইনি। কিন্তু মনের মধ্যে টুং-টাং শুরু হয়ে গেছে। একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না? কেনই বা পারবো না? তারপরেই নিজের অকল্পনীয় অবিমৃষ্যকারিতায় নিজেকেই ধমক দিয়েছি, স্পর্ধা বটে! ইতিহাসের গল্প লেখার শখ? ছেলেখেলা, নাকি?
কিন্তু কল্পনায় কে লাগাম দেবে? মনে মনে দুটি নাটকের ঐতিহাসিক কালে বিচরণ চলতেই রইল। অনেক চরিত্রের দেখা পেলাম, অনেক কথা, অনেক ঘটনা। ইতিহাস যাদের মনে রাখেনি। এমনও হয়েছে, দিবালোকে জাগ্রত চিন্তায় অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনার জট ছাড়াতে পারছি না। রাতে আধো-ঘুমে সে সব ঘটনার সূত্র দিব্যি জুড়ে গিয়েছে। প্রায়ই মনে হয় লিখে ফেলাই তো যায়, কিন্তু ভয় হয়, ফের ধাষ্টামো করব? আবার ভাবি, লিখে না রাখলে যে সব ভুল হয়ে যাবে।
চিন্তা মস্তিস্ককে শুধু উত্তপ্তই করে, কলমের জড়তা ভাঙ্গাতে পারে না। বহু শতাব্দীর পুরনো বিস্মৃত সব ছবি মাথার মধ্যে শুধু উড়তে থাকে। উড়তেই থাকে।

Comments

Popular Posts