যাত্রা শুরু

নাবিক যখন তার নৌকাখানা দরিয়ায় ভাসায়, পিছনের দিকে দেখলে কি চলে? নতুন উদ্যম, মজবুত নৌকা, নতুন পালে উজানের হাওয়া-- তখন তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে। পিছনের তটরেখা কখন ঝাপসা হয়ে অবশেষে মিলিয়ে গেছে জানতেই পারে না। তারপর অনেক পরে যখন সম্বিত ফেরে, তখনও গন্তব্য কিন্তু বহুদূরে। অথচ পিছন পানে চেয়ে দেখে ছেড়ে আসা বন্দরটিও আর দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে শুধু জল আর জল।
সেদিন বিরাটকায় এয়ারবাস ৩২০এ বিমানখানা যখন আমাকে নিয়ে মাটি ছেড়ে পুঞ্জীভূত মেঘরাশির দিকে তার উড়ান শুরু করল, তখন অবশ্য এসব কথা ভাবছিলাম না। প্রশ্নই নেই। এইসব ভাবার সময় তখনও আসেনি। চলেছিলাম এক চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। চিন্তাস্রোতটা বইছিল সেই খাতেই। নতুন চাকরির মোহময় সম্ভাবনা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একটা ধোঁয়াটে ছবি। অবশ্য মূল ভাবনাটা ছিল চাকরিটা আদৌ হবে কিনা। আর প্রেক্ষাপটে ছিল অনভ্যস্ত বিমানযাত্রার সন্ত্রস্ত অনুভূতি।
জানা ছিল এ চাকরি পেলে আমাকে চলে যেতে হবে আমার পরিচিত গন্ডীর বাইরে। তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাও ছিল। আসলে বাল্যকালের অতি রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে একটা সুরক্ষিত, জটিলতামুক্ত জীবনের অভ্যাস। সুতরাং সাবালকত্ব যে সময়ে আসার কথা, আসেনি। তার ওপর সামান্য ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়াটাও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তবে সেই দিন ভূমি থেকে ক্রমশ উত্তরণের পথে অবচেতনাই সান্ত্বনা দিচ্ছিল-- আরে আগে হোক তো চাকরি, তারপর ওসব ভাবা যাবে।
সত্যি কথা বলতে আমার প্রবাসবাসের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বত্রিশ বছর বাড়ীর ভাত খেয়ে সরলরৈখিক জীবন কেটেছে। মাঝে বাড়ি ছেড়ে থাকা বলতে দু'বছরের জন্যে খড়গপুরে হোস্টেল বাস। কিন্তু সেটাকে ঠিক প্রবাস বলা চলে না। তখন যে বয়েস তাতে ধরণীকে পায়ের তলায় অনুভব করাটা খুব সহজ ও স্বাভাবিক বিভ্রান্তি। তাছাড়া দূরত্ব নগণ্য, সপ্তাহান্তে বাড়ি আসা যেতো। হোস্টেল জীবনের মাদকতায় প্রবাসের হুল ছিল না। কখন যে হুস করে দু'বছর পার হয়ে গেল জানতেই পারিনি।
যদিও অনেকদিন থেকেই মনে হত পৃথিবীর যে কোনও কোণায় গিয়ে থাকতে পারি, তবু অকারণেই এই বিশ্বাসটাও এসে গিয়েছিল-- সে সব দরকার হবে না। তখনও পর্যন্ত কোনও ঠোকর খেতে হয়নি। ওইরকম তরতর করেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে বাড়ীর ভাত খেয়ে-- এমনই একটা ধারণা কখন যেন মনে বসে গিয়েছিল। কিন্তু বিধাতাপুরুষ মুচকি হেসে বেমওকা একটা উল্টো চাল চেলে দিলেন। হঠাতই বত্রিশ বছর বয়সে বলতে গেলে ঢাল-তরোয়াল ছাড়াই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়লাম। কী করে বলতে গেলে একটু আগের কথা বলতে হয়।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে চাকরি করতাম একটা প্রাইভেট সংস্থায়। সংস্থাটি বহুজাতিক এবং মোটামুটি সম্পন্ন। তাই চাকরিতে নিরাপত্তার অভাব ছিল না। কোম্পানির বাসে করে যাওয়া আসা। অফিসের কাজে তেমন চাপ নেই। হাতে নিজস্ব অনেক সময়। মাস গেলে মাইনেটা একটু কম, তাও খুব খারাপ নয়। ভালোই চলছিল, কিন্তু আমার ক্রমে মনে হতে লাগল, বোধহয় ভুল জায়গায় সময় নষ্ট হচ্ছে।
আমার কাজটা ছিল হরেক রকম বিদ্যুৎ উপকরণ ডিজাইনারের। যাকে বলে সুইচগিয়ার-- প্রথমে লো ভোল্টেজ, তারপর হাই ভোল্টেজ। ব্যাপারটা কাগজে-কলমে। নতুন নতুন বিদ্যুৎ প্রকরণের প্ল্যান ড্রয়িং বোর্ডে জন্ম নিত। প্রণালী জটিল হলে ড্রাফটসম্যানদের সরিয়ে নিজেই সেগুলো কাগজে নামিয়ে ফেলতাম। সেসব প্রশংসিতও হত। কিন্তু দেখতাম, আসল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে নতুন আইডিয়ার খুব একটা জায়গা নেই। সেখানে গতানুগতিক পদ্ধতি ও পুরনো পরীক্ষিত টেকনোলজিই চালিয়ে যেতে হত। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাশিক্ষায় উৎসাহীদের প্রণোদিত হবার পরিবেশ সেখানে তেমন ছিল না।
এদিকে বাড়ীতে সরকারী কাজের আবহাওয়া। গুরুজনেরা সব সরকারী চাকুরে। সবাইএর পেশা অধ্যাপনা। শুধু ছোটকাকা ছিলেন রেলের বড় অফিসার। মূলত তাঁরই প্রভাবে ধারণা হয়েছিল, গভর্নমেন্ট সার্ভিস ছাড়া এ জীবন বৃথা। সেই প্রাক-বিশ্বায়ন কালে এ কথা খুব ভুলও ছিল না। প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। কিন্তু একটা চোখ থাকতো কী করে গভর্নমেন্ট সার্ভিসে যাওয়া যায়। নয় নয় করে ন'বছর পরে এসে গেল সেই সুযোগ।
আমাদের কোম্পানিরই এক প্রডাক্ট শর্ট-সার্কিট টেস্ট করাতে নিয়ে যেতে হল ব্যাঙ্গালোর-স্থিত এক পরীক্ষাগারে। বিদ্যুৎ মন্ত্রালয়ের অধীন এই ল্যাব তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় শর্ট-সার্কিট পরীক্ষাগার। আমার ঊর্ধ্বতন যে অফিসারের যাবার কথা, কোনও কারণে তিনি না যেতে পারায় আমাকে এই দায়িত্ব নিতে হয়। পরীক্ষার উপকরণটি আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য ছোটোখাটো জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে এক অগাস্টের শেষে ব্যাঙ্গালোরগামী এয়ার ইন্ডিয়ার-- তখন ইন্ডিয়ান এয়রালাইন্স-- ফ্লাইট ধরা গেল। সেই ছিল আমার প্রথম বিমানযাত্রা!
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, রেলের থ্রী-টায়ার স্লিপারে সফর করে থাকি। প্রথম বিমানযাত্রার অনুভূতি আর কী করে ব্যক্ত করি? একমাত্র ভুক্তভোগীই কিছুটা জানবেন। হাওয়াই সফরের নিয়মকানুন কিছুই জানি না। শুনেছি অনেক অনেক চেকিং ও বহু বিধি-নিষেধ আছে। আমার সঙ্গে প্রায় কুড়ি কেজি ওজনের তামার বাস-বার। টেস্টিংএ লাগবে। অফিস থেকেই প্যাক করে দিয়েছে, আবার আমার সুবিধের জন্যেই সেই প্যাকে বহন করবার উপযোগী এক স্ট্র্যাপ লাগানো। কাঁধে ঝোলালে আকার ও ওজনে ঠিক স্টেনগান বলে বোধ হয়! কী জানি নিয়ে যেতে দেবে কিনা। কাকা বললেন, কেবিনে যাবে না তবে লাগেজে বুক করে নিলে অসুবিধে নেই।
তখনও 'কেবিন', 'লাগেজ' এসব না বুঝলেও নির্দিষ্ট দিনে সেই 'স্টেনগান'-সজ্জিত হয়েই দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম। বিমানবন্দরে অবশ্য কোনও অসুবিধে হয়নি। 'স্টেনগান' 'লাগেজে' চলে গেল, আমি বোর্ডিং পাস হাতে সুরক্ষা বেষ্টনী পেরিয়ে উড়োজাহাজের 'কেবিনে' ঢুকে পড়লাম। তখনই বাইরে শুরু হল বৃষ্টি।
ক্ষুদ্রাকৃতি জানলা দিয়ে দেখি, তুমুল বর্ষণের মধ্যেই বিমান যাত্রা শুরু করে অচিরেই মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ল। আর অবাক কান্ড, তারপরেই কড়া রোদ! মেঘলোক পেরিয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল অন্তরীক্ষে উত্তরণের সে এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা!
আড়াই ঘন্টায় ব্যাঙ্গালোর! ছোট্ট বিমানবন্দরে অবতরণ করেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই শহরে সেই প্রথম। সে এক অপার্থিব অনুভূতি। স্ফটিক-স্বচ্ছ আকাশ আর শ্যাম-শীতল হাওয়া। এই ঋতুতেও যে আমাদের দেশে সোয়েটার পরা যায়, এ আগে জানা ছিল না!
হ্যাঁ, ব্যাঙ্গালোরের এয়ারপোর্ট তখন সত্যিই ছোট্ট ছিল। আর শুধু এয়ারপোর্ট কেন, গোটা ব্যাঙ্গালোরই তখন এক ছোট্ট শহর। বড়সড় মফঃস্বলই বলা যায়। অন্তত আমার কলকাতা শহর দেখা অভ্যস্ত চোখে সেইরকমটাই মনে হয়েছিল। কলকাতার চেয়ে একটু পরিচ্ছন্ন কিন্তু এখনকার মেট্রোপলিটান চাকচিক্য তখন ছিল না। এ সেই সময়ের কথা যখন নারায়ণমূর্তি সবে ইনফোসিসকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, ব্যাঙ্গালোরের আই-টি হাব হয়ে ওঠা সুদূর পরাহত। আজকের বেঙ্গালুরুর থেকে সেই শহরের অনেক ফারাক। কোথায় ইলেক্ট্রনিক সিটি, কোথায় ফ্লাই-ওভার, কোথায় ঝাঁ-চকচকে শপিং কমপ্লেক্স আর কোথায় বা তার বহিরঙ্গের এই আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদ।
কিন্তু বিমানযাত্রা নয়, নতুন শহর নয়। আমার মনোহরণ করে নিল ভারত সরকারের সেই নবনির্মিত আধুনিক পরীক্ষাগারটি! অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষণ-প্রণালী দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! সবই চূড়ান্ত বৈদ্যুতিক প্রকরণ, কিন্তু আমার অধীত বিদ্যায় তার যেন কূল পাই না! বিদ্যুৎবিদ্যার এ যেন নতুন রাজ্য-- কতো নতুন তত্ত্ব হাতে কলমে শিখে নেওয়া যায়!
পরীক্ষা-টরিক্ষা শেষ করে ফিরে আসবার পথে বারবার মনে হচ্ছিল, আহা, চাকরি যদি করতেই হয় তো এইখানে। আমার বিদ্যুৎ নিয়ে পড়াশোনা তাহলে সার্থক হয়। আর চাকরিও তো যে সে নয়, খোদ কেন্দ্র সরকারের!
এমনিই ভেবেছিলাম। ভালো জিনিষ দেখলে যেমন লোভ হয়। কিন্তু তার পরেই সেই নাটকীয় যোগাযোগ! ডিসেম্বরে মাসেই দেখলাম ঐ সংস্থায় ইঞ্জিনিয়ার পদের বিজ্ঞাপন। যোগ্যতামান বিলকুল আমার যা আছে তাই। বেতনের অঙ্কটাও যথেষ্ট আকর্ষণীয়, কিন্তু আমার কাছে তখন সেটা গৌণ। আবেদন করতে দেরী করিনি। যথাসময়ে ডাকও এলো। তারই ফলশ্রুতি আমার এই দ্বিতীয় হাওয়াই সফর। একান্ত চেষ্টা করেছিলাম ট্রেনে যেতে। প্রতীক্ষাসূচীতে নম্বর ছিল ১৮৪, শেষ পর্যন্ত বার্থ পাওয়া গেল না। অগত্যা আকাশপথে যাত্রা।
যে সময়ের কথা তখন আমার মত মধ্যমবর্গীয়ের পক্ষে বিমানমাশুল দিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাবার কথা অকল্পনীয় ছিল। গন্তব্য সেই একই। কিন্তু গতবারে ছিল কোম্পানির খর্চায় ভ্রমণের সুযোগ। এবার তা নয়। টিকিটের দাম দিতে হবে আমারই কষ্টার্জিত অর্থে। আহ্বায়ক সংস্থা যদিও রেলের প্রথমশ্রেণীর যাত্রাখরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু সেটা খুব একটা আশাপ্রদ নয়। কেননা তৎকালীন বিমান ও রেলে যাত্রীভাড়ার পার্থক্যটা আমি যেখানে আগে কর্মরত ছিলাম তার মাস মাইনের চেয়ে বেশী।
কিন্তু আর কোনও উপায় ছিল না। অনেক ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে। যদিও তখনও জানি না আমি নির্বাচিত হব কিনা। কিন্তু একটা চান্স তো নিতেই হবে। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল। সুতরাং বহুমূল্য টিকিটটা নিয়ে আকাশপথেই পাড়ি দিলাম ইন্টারভিউ দিতে। মনে আছে অন্তরীক্ষ থেকে এবার বঙ্গোপসাগরের উপকূল পরিষ্কার দেখতে পেয়ে অর্থদণ্ডের শোক অনেকটা ভুলেছিলাম।
ইন্টারভিউ বেশ খারাপ হয়েছিল। অনেক জানা, সহজ প্রশ্নেরও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিনি। ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন সংস্থার কর্ণধার স্বয়ং-- স্বনামধন্য ডক্টর রামমূর্তি। ইনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রযুক্তিবিদ। পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের এক সমীহ জাগানো নাম। এনার বই আমরা পড়েছিলাম। ঐ উচ্চতার এক ব্যক্তিত্বের সম্মুখে আমার সব কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল। তবু কেন কে জানে, যেটুকু বলতে পারছিলাম তাতেই কিন্তু উনি খুব খুশী হচ্ছিলেন। আর যা পারছিলাম না তা সযত্নে কাগজে লিখে, ডায়গ্রাম এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
ইন্টারভিউএর পরে আমার যতটা মুষড়ে পড়ার কথা তা কিন্তু হল না। বাস্তববুদ্ধি বলছে, নির্বাচনের সম্ভাবনা কম। কিন্তু কোনও কারণে যেন মনের কোণায় উঁকি দিচ্ছে, এ চাকরিটা হয়তো পেতেও পারি। কেন তা বলতে পারব না।
আর এই একবার অন্তত আমার অনুমান মিথ্যা হল না। মাস দুই পরেই সেই মোটাসোটা সরকারী নিয়োগপত্র এসে হাজির! আগামী পনেরো দিনের মধ্যেই কাজে যোগদানের আদেশ।
তারপর আর কী, কূল হারানোর পালা। বিরানব্বই সালের বিশে জুলাই করমন্ডল এক্সপ্রেস যখন আমাকে নিয়ে হাওড়া ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল, সে টেনে ছিঁড়ে দিয়ে গেল আমার আজন্মের শেকড়টা। এতদিন তোড়জোড় চলছিল, এবার সত্যিই ছিন্নমূল হলাম।
যদিও ছিন্নমূল হবার প্রকৃত অর্থ তখন সম্যক উপলব্ধি হয়নি। জানতাম না, চারাগাছ পরিণত হলে আর প্রতিস্থাপিত হয় না। হয়তো মরে যায় না, কিন্তু পত্রপুষ্পের পূর্ণমহিমায় কি আর বিকশিত হয়? বোধহয় না। যে জায়গা সে ছেড়ে যায় সে আর তার থাকে না। যেখানে সে হাজির হয় সেও তার হয় না। ছিন্নমূল হওয়া কাকে বলে তখনই সঠিক হৃদয়ঙ্গম হয়।
শুরু হয়ে গেল আমার প্রবাস-তীর্থ পরিক্রমা। 

Comments

Popular Posts