দৃশ্যান্তর


পড়াশোনা করে মানুষ হওয়াটা যদি হয়ে যায় ঘোরতর অন্যায়, অপরাধ, অসামাজিক, তাহলে কি হয়?

দৃশ্য ১

সকালবেলা বাবা ঘুম থেকে উঠে মাকে বলছেন, 'তা হ্যাঁগো, ওর বন্দুকের গুলিগুলো কোথায়? রোজ রোজ তো কিনে দিতে পারবো না। ব্ল্যাকে অতি কষ্টে জোগাড় করা। হারিয়ে গেলে গায়ে লাগে, বুঝলে?
মা বললেন, 'আর কেনই বা কেনা? ওতো ঠিক করে চালাতেই পারে না। এ ছেলের জন্যে পাশের বাড়ীর বৌদির কাছে মুখ দেখানো দায় হয়েছে। ... ওদের ছেলে, তিনবার জেলখাটা হয়ে গেছে, একবার ডাকাতির কেস, দু'বার রাহাজানি। ...হ্যাঁগো, আমাদের ছেলের নাম কি কোনোদিন ওয়ান্টেডের লিস্টে দেখতে পাবো না? একটা কেসেও ফাঁসবে না?
—'কেঁদো না কেঁদো না,...সবই আমাদের কপাল। অথচ তুমিই বল, আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটি রেখেছি? এলাকার টপ সমাজবিরোধীদের কাছে টিউশন দিয়েছি, হাজার হাজার টাকা খচ্চা করেছি, কোন লাভ হয় নি ...'
—'ওকে এও বললাম, তোর যদি লাইনটা পছন্দ না হয়, না হয় লাইন চেঞ্জ করে নে। ডাকাতি রাহাজানি ছাড়া কি আর পথ নেই? তুই না হয় ছিঁচকে চোরই হ', ... কিছু না হোক টিকিট ব্ল্যাক কর। আরে তোর দাদুর পরে এ অঞ্চলে একটাও প্রতিভাবান ব্ল্যাকার হল না। শুনল না।'
—'আরে আমি তো এটাও বলেছিলাম, একটু মন দিয়ে গাঁটকাটা, পকেটকাটা যদি শিখতে পারিস, বসকে বলে তোকে বিলেতে পাঠাবো স্মাগ্লিং-এর কোর্স করতে। তাও না...'
—'ওর কি যে মাথায় পড়ার ভুত চেপেছে! সকালে দেখো, সন্ধেয় দেখো, সর্বদা বই মুখে...এইভাবে অন্ধকার ভবিষ্যতের সম্ভাবনাটা নষ্ট করে গো?'

দৃশ্য ২

মা দুঃখ করে বলছেন, 'জানো, ওর খাওয়ার অব্যেশটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে।'
বাবা চিন্তিত স্বরে বললেন, 'কার?'
—'কার আবার, তোমার গুণধর পুত্র। রোজ দু'প্যাকেট করে ইস্পেশাল বিড়ি আনি। একদমে টেনে শেষ কত্তেই পারে না!'
—'সেকি! ওর বুকে কোন কষ্ট-টষ্ট নেই তো। এই বয়সে তো ফুল দমে টানার কথা? আমি তো ওর বয়সে... তা কই ডাকো তো ওকে...।'
মা আদর করে ছেলেকে ডাকলেন, 'সোনা, বাবা লক্ষ্মীটি, আয় বাবা একবার...। এই দ্যাখো তোমার বাবা তোমার জন্যে নতুন কল্কে নিয়ে এসেছেন। টান বাবা, সোনা ছেলে, টান একবার...।'
বাধ্য ছেলে কল্কেটা নিয়ে একটা ছোট্ট টান দিতেই কেশে-টেশে একাকার। বাবা রেগে গেলেন, 'কাশো কাশো, ভালো করে কাশো। ভালো জিনিশেই তোমার যত ন্যাকরা, না? কই, যখন ঐ ছাইপাঁশগুলো গেলো, দুধ ঘি মাখন..., তখন তো কাশি হয় না?'
—'আহা থাক। বাছাকে আমার আর বোকো না।'
—'না বকবে না! দেখো গে পাশের বাড়ীর পটলাকে। টানাটানির সংসার, বাপ দুটো করে সিগ্রেট দেয়। তাই জ্বালিয়ে বুঝিয়ে কতো যত্ন করে দিনভর প্র্যাক্টিস করে। আর তুই হতচ্ছাড়া, এখনও পিস্তল ধত্তে পাল্লি না। আর কবে স্টেনগান ধরবি? কবে আর আর-ডি-এক্স পাচার করবি?...'
—'আমাদের ভাগ্যে আর এসব দেখা নেই গো। এই দ্যাখো না, ওরই বন্ধু দুলু, যেমন নাম তেমনি ছেলে। সর্বদাই দুলছে... সেদিন সন্ধেবেলা শুনতে পেলাম টলতে টলতে দুলু তার মাকে বলছে, এই দ্যাখো মা আমি কেমন নেশা করেছি। আহা, কান জুড়িয়ে গেল। আমার পোড়া কপালে কি আর এ সুখ আছে?'

দৃশ্য ৩

আর একদিন। সন্ধে ছ'টা, ছেলে বাড়ীতে ঢুকলো। বাবা রাগে ফেটে পড়লেন, 'হতচ্ছাড়া, এইটে তোমার বাড়ী ফেরার সময়! বলেছি না অন্তত দু'টো কেস না করে রাত দু'টোর আগে বাড়ীতে ঢুকবি না? কোথায় গেছিলি... বল কোথায় গিছিলি?'
ছেলে মাথা হেঁট করে চুপ করে আছে। পেছনে ধরা হাত থেকে টুক করে কি একটা জিনিস মাটিতে পড়ে গেল। বাবা ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিয়ে দেখেই চোখ কপালে তুলে চিৎকার করে উঠলেন, 'অ্যাঁ, কলেজের আই কার্ড! তু-ত্তুই কলেজেও যাচ্ছিস? অ্যাঁ...ওগো, আমার প্রেশারের ওষুধটা দাও। এ ছেলের পাল্লায় পড়ে...।'
মা ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন। অতিকষ্টে বললেন, 'ওগো এই দ্যাখো, ওর আলমারি থেকে কি পেলাম! এই মোটা মোটা দু'টো বই, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির! ওগো কি হবে গো?'
—'ওরে হতভাগা, তুই এই সব বই পড়া ধরেছিস? ওরে তোর ঠাকুমা, আমার মা, কতো সাধ করে তোর নাম রেখেছিল অপোগণ্ড, তা কি এই দিন দেখার জন্যে? ওরে...ওরে..., তোকে কতো করে বললাম না, সামনে বিগ বাউন্ডুলে কম্পিটিশন। রোজ অন্তত দু'টো করে এ-মার্কা নাইট শো দেখ। না হলে যে অডিশনেই আউট হয়ে যাবি রে মুখ্যু!... তুই বেরিয়ে যা, এই মুহূর্তে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যা... আর তোর মুখ দেখবো না।'
ছেলে মাথা নীচু করেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল।

দৃশ্য ৪

ছ'মাস পর। ছেলে বাড়ী ফিরেছে। ফুল টাইট। জড়ানো গলায় চীৎকার করলে, 'অ্যাই বাপ, দজ্জা খোল... শিগগির খোল। না খুলবি তো দেবো নাকি কানের গোড়ায় অ্যাকখান...'
মা গদগদ স্বরে স্বামীকে বললেন, 'ওগো, আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন গো। তোমার ছেলে আজ মানুষের মতো মানুষ হয়ে ফিরেছে। আহা, আজ মা থাকলে কতো আনন্দ করতেন, তাঁর নাতি বাপকে বলছে কানের গোড়ায় দেবে... আহা...!'

(সৌজন্যঃ মীরাক্কেল)

Comments

Popular Posts